Tuesday, October 23, 2018

তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ

রবীন্দ্রনাথ খুব বিচলিত হয়ে এই কথা লিখেছিলেন। তখন কবি জানতেন না কি দিন আসছে। কথাটা মনে পড়ল কারণ প্যারিসের ঘটনার পর একজন স্ত্রী হারানো স্বামী লিখেছেন তিনি সন্ত্রাসকারী দের কে তাঁর ঘৃণা উপভোগ করতে দেবেন না।  তিনি জানেন এরা চায় মানুষ ভয় পাক, ঘৃণা করুক, উনি তা সফল হতে দেবেন না।  এই কথা বলতে এবং কাজে পরিনত করতে প্রচন্ড মনের জোর লাগে, খুব কম মানুষেরই সেই জোর আছে।  কবি ক্ষমা করতে পারেননি তাদের যারা তাঁর আলো নেভাচ্ছিল এবং বায়ু বিষাক্ত করছিল।
আজকে আমাদের সামনে এক অদ্ভুত অবস্থা তৈরী হয়েছে। আজ যারা আলো নেভাচ্ছে, বায়ু বিষাক্ত করছে তাদের কোনো অপাত্ দাবী নেই, মৃত্যুর পরোয়া নেই।  তারা মেরে আর মরে খুশি। এমন অবস্থা ইতিহাস আগে দেখেছে বলে আমার জানা নেই। এদের সঙ্গে আপোষ করার কিছু নেই কারন এরা কিছু চাইছে না।  এরা কোন বাছবিচার করছেনা কে মরল কে বাঁচলো। তাই সারা বিশ্ব ভেবে পাচ্ছেনা কি করে এদের থামানো যাবে। অনেক এই বলছে এদের নিঃশেষ করতে হবে।  ভালো কথা, কিন্তু ঠিক কি ভাবে তা হবে? পরশুরাম ২১ বার পৃথিবী নিঃক্ষত্রিয় করেছিলেন তাতেও কাজ হয় নি।  তাই মনে হয় শেষ করব বললেই শেষ হয় না।  যুদ্ধ শেষ করার শেষ যুদ্ধ বলে কিছু হয় না।  আসলে মানুষ স্বভাবত ক্ষমতালোভী।  নিজের সুবিধার্থে, বাঁচার তাগিদে সমাজ বানিয়ে একত্রে থেকেছে, কিন্তু যেই একটু সুবিধা হয়েছে ক্ষমতা নিজের হাতে নিয়ে অন্যদের থেকে এগিয়ে যেতে চেয়েছে। তারপর অন্যরা বাধা দিয়েছে ব্যস ধুন্ধুমার লেগে গেছে। এ থামার নয়।  তাই যারা শান্তির বাণী নিয়ে এসেছেন তাঁদের ব্যর্থ নমস্কারেই ফেরাতে হবে।
আমার মনে হয় আমাদের কাজ করতে হবে এটা ধরে নিয়ে যে মানুষ স্বভাবত হিংস্র, তারা ক্ষমতা নেবার চেষ্টা করবেই, তারা স্বভাবতঃ অত্যাচারী, তা যদি করি তাহলে হয়ত শেষ অবধি একটা রাস্তা বের হবে যেখানে লোকে ঠিকমত থাকতে পারবে। 

Thursday, December 3, 2015

কিমাশ্চর্যম

যুধিষ্ঠির কে বক রূপী যক্ষ জিজ্ঞেস করেছিলেন, "আশ্চর্য কি?" উত্তরে যুধিষ্ঠির বলেছিলেন, প্রতিদিন বহু মানুষ যায় তবু মানুষ অমর হতে চায়, এটাই আশ্চর্য। ছোটবেলায় এটা পড়ে মনে হয়েছিল খুব সত্যি কথা। কিন্তু আজকে আমি যুধিষ্ঠির এর সাথে এক মত হতে পারছি না। আমার মনে হয় আশ্চর্য একটা সম্পূর্ণ অন্য ব্যাপার। মানুষের জীবনে একটাই অনিবার্য সত্য - মৃত্যু। তবু সারা পৃথিবীতে অনেক বেশী সময়, এবং অর্থ ব্যয় হয় মারণাস্ত্র তৈরি করতে। মনে হয় সবাই চায় অবশ্যম্ভাবী কে আরও কাছে নিয়ে আসতে। এর চেয়ে বড় বিস্ময় আর কি হতে পারে। জানি না কেন যুধিষ্ঠির এটা ভাবেন নি। হয়ত নিজেও যুদ্ধের জন্য তৈরি হচ্ছিলেন তাই এই ভাবে দেখেন নি ব্যাপারটা। 

আমি জন্মেছি দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের এক যুগ পরে। গল্প শুনেছি তার, তারও আগে প্রথম বিশ্ব যুদ্ধের গল্প, তা বাদে বিভিন্ন দেশের আর বহু পৌরাণিক যুদ্ধ কাহিনী। তখন কিছু মনে হয়নি খালি অবাক বিস্ময়ে বীরেদের গল্প শুনেছি। এখন মনে হয় এই ভাবেই ছোট থেকে আমরা তৈরি করি সবাইকে কি ভাবে অমর হতে চাওয়াতে আশ্চর্য হতে হয় কিন্তু অকালমৃত্যু স্বাভাবিক বলে মেনে নেওয়া যায়। হয়ত একটু কঠোর হয়ে গেল কাথাটা তবু মনে হয় সত্য থেকে খুব দূরে নয়। 
এরপর অনেক যুদ্ধ দেখেছি কাছ থেকে দূর থেকে। তা নিয়ে অনেক কথা অনেক আলোচনা কিন্তু সবই দর্শকের ভুমিকায় থেকে। হঠাৎ একদিন কেমন সব পাল্টে গেল। দেখি যুদ্ধ একদম হাতের গোড়ায় এসে গেছে। কে শত্রু কে মিত্র বোঝা যায় না। এত দিন যা বহু দূরে ছিল একদিন তার অংশ হয়ে গেলাম কোন প্রশিক্ষণ ছাড়াই। আমি সেদিন বম্বে তে অফিস থেকে বাড়ি ফিরছি। তখন ও ক্রিকেট নিয়ে উন্মাদনা ছিল মনে, তাই নিরর্থক একটা ক্রিকেট ম্যাচ - ভারত বনাম ইংল্যান্ড - তার ধারাবিবরণী শুনছিলাম। জানতাম ও না আমার ৫০০ মিটারের মধ্যে কি নারকীয় কান্ড চলছে। বাড়ি ফিরে খেতে বসে শুনছি বাইরে বাজি ফুটছে, অবাক হয়ে ভাবছি এই খেলার জন্য বাজি ফুটছে কেন? বন্ধুদের ফোন পেয়ে ভুল ভাঙল, তারপর পরের পর বিনিদ্র রজনী, আর চিন্তা, কি হল, কেন হল। আর আগেই ঘটে গেছে নিউ ইয়র্কের ঘটনা। কিন্তু সেটা ছিল অন্য রকম, মুহুর্তে ঘটে যাওয়া সাংঘাতিক মারণ যজ্ঞ। আর বম্বেতে চলেছিল অনেক দিন ধরে।  আজও জানি না সেই ঘটনা থেকে কার কি ভাল হয়েছিল।  অনেক গুলো প্রাণ শেষ হয়ে গেছিল যারা জানতেও পারেনি কি কারণে এই আঘাত। 

আজ বহু বছর পরে আবার একই ধরনের ঘটনা ঘটল প্যারিস শহরে। আমার ভাগ্য ভাল আমি সেদিন প্যারিস থেকে দুরে ছিলাম। কিন্তু ঘটনা অন্য রকম হতেই পারত, আমার কথা ছিল বন্ধুদের কনসার্ট শুনতে যাবার, আর সেই জায়গাটা অকুস্থল থেকে খুব একটা দুরে নয়।  এখন সারা প্যারিস শহরে একটা অদ্ভুত অস্থিরতা বিরাজ করছে।  লোক রাস্তায় বেরোচ্ছে ঘুরছে ফিরছে কিন্তু কেমন যেন একটু নিস্প্রাণ। মাঝে মধ্যে স্টেশন বন্ধ করে সন্দেহজনক বাক্সের ব্যবস্থা করছে পুলিশ। এই সময় এখানে ক্রিসমাসের বাজার আর মেলা বসে, এবার ও বসেছে কিন্তু কেনার প্রায় কেউ নেই। সবাই ভীড় হতে পারে এমন জায়গা এড়িয়ে চলেছে। ব্যবসার অবস্থা খারাপ। অর্থনীতির উন্নতির আশা কম।  

এরই পাশে সারা পৃথিবী জুড়ে প্রকৃতির তান্ডব চলছে, খরা, বন্যা, ঝড়ে সবাই সন্ত্রস্ত, কিন্তু তবু মানুষের তৈরী অস্ত্রে অনেক বেশি লোক মারা পড়ছে। এক দিকে আমরা চেষ্টা চালাচ্ছি কি ভাবে প্রকৃতির হাত থেকে আগামী প্রজন্মকে বাঁচানো যায়, তার জন্য পৃথিবী জোড়া সন্মেলন হচ্ছে, সব দেশ নানান প্রতিজ্ঞা করছে আর অন্য দিকে আমরা তৈরী করছি নতুন নতুন মারণাস্ত্র। তাই প্রশ্ন জাগে যুথিষ্ঠিরের কি আজও মনে হত অমর হওয়ার বাসনাই সবচেয়ে আশ্চর্যের?